পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর ৭টি বৈজ্ঞানিক উপায়

পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারছেন না? জানুন পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর উপায়, একাগ্রতা বৃদ্ধির কৌশল ও বৈজ্ঞানিকভাবে কার্যকরী ৭টি টিপস।

পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর ৭টি বৈজ্ঞানিক উপায়
পোস্ট সূচিপত্র

পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর ৭টি বৈজ্ঞানিক উপায়

আমাদের অনেকেরই পড়াশোনার সময় মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। কখনো মোবাইল, কখনো ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আবার কখনো অযথা চিন্তাভাবনা মনোযোগ নষ্ট করে দেয়। অথচ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কিছু অভ্যাস ও কৌশল প্রয়োগ করলে পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখা অনেক সহজ হয়ে যায়। এই পোস্টে আজ আমরা জানবো পড়াশোনায় কনসেন্ট্রেশন বা একাগ্রতা বৃদ্ধির উপায়, পড়াশোনার সময় মনোযোগ বাড়ানোর কৌশল সম্পর্কে। এই পোস্টে কার্যকরী ৭টি বৈজ্ঞানিক উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর কথা নয় চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক, পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর ৭টি বৈজ্ঞানিক উপায় সম্পর্কে।

আরো পড়ুন : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪ প্রবন্ধ রচনা

১. নির্দিষ্টভাবে পড়ার পরিবেশ তৈরি করা

পড়াশোনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা একাগ্রতা বা মনোযোগ বৃদ্ধির সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের চারপাশের পরিবেশ সরাসরি মনোযোগের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। অগোছালো, শব্দযুক্ত বা বিশৃঙ্খল জায়গায় পড়তে বসলে মস্তিষ্ক বারবার বিভ্রান্ত হয় এবং শেখার গতি কমে যায়। তাই পড়াশোনার জন্য একটি নিরিবিলি ও গোছানো পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সর্বপ্রথমেই আপনার পড়ার স্থানটি আলাদা করে নিন। এটি হতে পারে আপনার রুমের একটি কোণা বা টেবিল-চেয়ারে। যদি টেবিলে বসেন তাহলে টেবিলে থাকা অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখবেন না, শুধু বই, খাতা ও পড়াশোনা রিলেটেড প্রয়োজনীয় সামগ্রী রাখুন। আলো-বাতাস যেন যথেষ্ট থাকে, কারণ কম আলোতে চোখ দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যায়। অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা মোবাইল বা টিভি পাশে রেখে পড়তে বসে, এগুলো পড়াশোনার মনোযোগ নষ্ট করার বড় শত্রু। তাই পড়ার সময় এসব ডিভাইস সরিয়ে রাখুন। একটি পরিচ্ছন্ন ও শান্ত পরিবেশে পড়লে আপনি বুঝবেন, পড়াশোনার সময় মনোযোগ ধরে রাখা অনেক সহজ হয়ে গেছে।

২. পোমোডোরো টেকনিক (Pomodoro Technique) ব্যবহার

একটানা দীর্ঘ সময় পড়াশোনা করা বেশিরভাগ সময় উল্টো ফল দেয়। মস্তিষ্কেরও বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। এই সমস্যার সমাধান হলো “পোমোডোরো টেকনিক”। ইতালিয়ান উদ্যোক্তা ফ্রান্সেসকো সিরিলো এই পদ্ধতিটি তৈরি করেছিলেন। এর মূলনীতি হলো ২৫ মিনিট পড়াশোনা, এরপর ৫ মিনিট বিরতি। মোট চারটি সেশন শেষে ১৫–২০ মিনিটের দীর্ঘ বিরতি নিতে হবে। পোমোডোরো টেকনিক (Pomodoro Technique) সম্পর্কে আরো জানকে এখানে ক্লিক করুন।

এই কৌশলটি ব্যবহার করলে মানব মস্তিষ্ক ছোট ছোট কয়েকটি অংশে তথ্যগুলো প্রক্রিয়া করে, ফলে এ প্রকৃয়ায় পড়াশোনা করলে তা দীর্ঘমেয়াদে মনে রাখতে সাহায্য করে। একটানা তিন-চার ঘণ্টা পড়ার চেয়ে টুকরো টুকরো করে পড়লে মনোযোগ ধরে রাখা অনেক সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার গণিতের একটি অধ্যায় শেষ করতে ২ ঘণ্টা লাগে, সেটি চারটি পোমোডোরো সেশনে ভাগ করুন। প্রতিটি সেশনের শেষে হালকা পানি পান করুন বা স্ট্রেচিং করুন। এই ছোট বিরতি শরীর ও মস্তিষ্ককে সতেজ করে তুলবে।

আরো পড়ুন : শ্রমের মর্যাদা রচনা ২০ পয়েন্ট সকল ক্লাসের

৩. প্রতিদিন পড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা

দেখা গেছে, যখন আমরা অযথা বই খুলে পড়তে বসি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে না যে, আসলে কী শিখতে হবে। এতে করে সময় অপচয় হয় এবং মনোযোগ বারবার এদিক-সেদিক সরে যায়। এজন্য পড়ার আগে ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, আজকে আমি জীববিজ্ঞানের একটি অধ্যায় শেষ করবো অথবা আজকে আমি গণিতের ১০টির সমাধান করবো, এমন লক্ষ্য নিলে মনোযোগ অনেক বেশি ফোকাসড হয়। তাই ছোট ছোট লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমে মস্তিষ্কে এক ধরনের তৃপ্তি কাজ করে, যা আমাদের আরও বেশি পড়তে উৎসাহিত করে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, লক্ষ্য নির্ধারণ করলে ডোপামিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা আনন্দ এবং প্রেরণা জোগাতে সাহায্য করে। তাই পড়ার আগে একটি "To-Do List" লিখে ফেলুন এবং কাজ শেষ হলে টিক চিহ্ন দিন। এতে করে আপনি বুঝতে পারবেন, দিন শেষে আপনি আসলেই কিছু অর্জন করেছেন কিনা?

৪. ডিজিটাল বিভ্রান্তি কমানো বা মোবাইল থেকে দুরে থাকা

সাম্প্রতী ডিজিটাল যুগে সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি হলো মোবাইল ফোন এবং ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। নোটিফিকেশনের শব্দ, মেসেঞ্জারের ম্যাসেজ কিংবা ফেসবুক স্ক্রল করার অভ্যাস আমাদের পড়াশোনার সময় মনোযোগ একেবারেই নস্ট করে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি নোটিফিকেশন পড়াশোনার প্রবাহ ভাঙতে গড়ে ২৩ মিনিট সময় নেয়। একজন শিক্ষার্থীর জন্য এটি কিন্তু খুবই ভয়ানক বিষয়।

এটা থেকে মুক্তি পেতে পড়াশোনার সময় মোবাইল পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হবে। এছাড়া ল্যাপটপ বা এ জাতিয় ডিজিটাল ডিভাইস পড়ার ডেস্ক থেকে দূরে রাখলে পড়ার সময় অযথা চেক করার প্রবণতা কমে যাবে। আরেকটি কৌশল হলো- "ডিজিটাল ডিটক্স", প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করুন, কিন্তু পড়াশোনার সময়ে একেবারেই ব্যবহার করবেন না। অনেক শিক্ষার্থী পড়তে বসে ইউটিউব ভিডিও দেখতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা নষ্ট করে ফেলছে। তাই মোবাইল বা এসব ডিভাইসের জন্য নিদ্দিষ্ট সময় তৈরী করে রাখুন, আর সেই সময়ের বাইরে এগুলো ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। এই নিয়ম মেনে প্রযুক্তি ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

৫. নিয়মিত ব্যায়াম ও মেডিটেশন করা

আমাদের শরীর এবং মস্তিষ্ক একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। নিয়মিত ব্যায়াম শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, যা মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করে। এর ফলে পড়াশোনার সময় মস্তিষ্ক সতেজ থাকে এবং যেকোন তথ্য প্রক্রিয়াজাত করতে সহজ হয়। প্রতিদিন অন্তত ২০–৩০ মিনিট হাঁটা, দৌড়ানো বা হালকা ব্যায়াম করলে স্বাভাবিকভাবে যেকোন কাজে মনোযোগ বাড়ানোর ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি ব্যায়াম মস্তিষ্কে এন্ডরফিন হরমোন নিঃসরণ করে, যা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।

অপরদিকে মেডিটেশনও একটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ভাল উপায়। নিয়মিত মেডিটেশন করলে মন শান্ত হয় এবং মনোযোগ দীর্ঘ সময় ধরে রাখা যায়। অনেক গবেষণায় প্রমাণিত যে, যারা প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট মেডিটেশন করেন, তারা পড়াশোনায় অন্যদের তুলনায় বেশি একাগ্র হয়ে থাকে।  যেমন, পরীক্ষার আগে নার্ভাসনেস কমাতে কয়েক মিনিট শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোযোগ দিন। দেখবেন, উদ্বেগ কমে গেছে। তাই পড়ার প্রতি মনোযোগ বাড়াতে মেডিটেশন অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

আরো পড়ুন : সময়ানুবর্তিতা রচনা

৬. সুষম খাদ্য গ্রহণ ও পর্যাপ্ত ঘুমের অভ্যাস তৈরী করা

শরীর ও মস্তিষ্কের জ্বালানি হলো খাদ্য ও পর্যাপ্ত ঘুম। জাঙ্ক ফুড, অতিরিক্ত কোল্ড ড্রিংস বা মিষ্টি খেলে অস্থায়ী শক্তি পাওয়া যায় বটে, কিন্তু পরে শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়। এসব খাবারের বদলে ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ, বাদাম, শাকসবজি, ফল ও ডিম খেলে মস্তিষ্ক দীর্ঘসময় সতেজ থাকে। একইভাবে, পর্যাপ্ত ঘুম না হলে পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ঘুমের সময় মস্তিষ্ক সারাদিনের শেখা তথ্যগুলো সাজিয়ে নেয়। তাই যারা প্রতিদিন ৬-৭ ঘণ্টার কম ঘুমায়, তাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায় এবং তাদের পড়ার গতি কমে যায়। তাই প্রতিদিন ৭–৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম নিশ্চিত করুন। রাত জেগে পড়াশোনার বদলে ভোরে উঠুন। এতে করে আপনার পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর উপায় কার্যকরীভাবে কাজ করবে।

৭. নিজেকে পুরস্কৃত করুন

আমরা সবাই প্রেরণা পেতে ভালবাসি। পড়াশোনার পর যদি নিজেকে ছোট ছোট পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ, এক ঘণ্টা পড়া বা একটা অধ্যায় শেষ করার পর প্রিয় চকলেট খাওয়া বা একটি গান শোনার মাধ্যমে নিজেকে পুরস্কৃত করা যেতে পারে।মনোবিজ্ঞানে এটিকে বলা হয় "Positive Reinforcement" যেখানে ছোট অর্জনের পর মস্তিষ্ক আনন্দ অনুভব করে এবং পরবর্তী কাজে আরও উৎসাহী হয়। এই কৌশল ব্যবহার করলে পড়াশোনাকে চাপের কাজ মনে হয় না। বরং মনে হয় প্রতিটি ধাপ শেষে একটি আনন্দ অপেক্ষা করছে। তাই নিজের জন্য একটি পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখুন। এটি হতে পারে ঘুরতে যাওয়া, পছন্দের সিরিজ দেখা বা শুধু প্রিয় নাস্তা খাওয়া। এতে করে আপনি পড়াশোনায় ধারাবাহিকভাবে আগ্রহী হতে থাকবেন।

FAQ : পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর ৭টি বৈজ্ঞানিক উপায়

প্রশ্ন ১: পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায় কী?

উত্তর: নির্দিষ্টভাবে একটি পড়ার পরিবেশ তৈরি করা এবং মোবাইল, ফেসবুক ও মিডিয়া এড়িয়ে চলা সবচেয়ে সহজ উপায়।

প্রশ্ন ২: পড়ার সময় ঘুম চলে আসলে কী করা উচিত?

উত্তর: শরীরের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। পর্যাপ্ত ঘুমালে এমনটি হবে না। তবুও ঘুম চলে আসলে পড়ার মাঝখানে একটু হাঁটাহাঁটি করুন।

প্রশ্ন ৩: মেডিটেশন কি সত্যিই পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ায়?

উত্তর: হ্যাঁ, বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে মেডিটেশন মন শান্ত করে এবং একাগ্রতা বৃদ্ধি করে।

প্রশ্ন ৪: পোমোডোরো টেকনিক কি সবার জন্য কাজ করে?

উত্তর: হ্যাঁ, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর জন্য কার্যকর, তবে কেউ চাইলে ৫০/১০ মিনিট নিয়মটিও ব্যবহার করতে পারেন।

উপসংহার : পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর ৭টি বৈজ্ঞানিক উপায়

প্রিয় পাঠক, পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর উপায় খুঁজতে গিয়ে আমরা প্রায়ই জটিল জটিল কিছু সমাধান খুঁজি। কিন্তু বাস্তবে ছোট ছোট অভ্যাস ও বৈজ্ঞানিক কৌশলগুলোই আমাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর হয়ে থাকে। পড়ার জন্য নির্দিষ্ট একটি পরিবেশ তৈরি, লক্ষ্য নির্ধারণ, পোমোডোরো টেকনিক, ব্যায়াম, মেডিটেশন, সুষম খাবার ও পর্যাপ্ত ঘুম এসব মিলিয়ে পড়াশোনায় স্থায়ী মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়তা করবে বলে আশা রাখছি। পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর ৭টি বৈজ্ঞানিক উপায় সম্পর্কিত এই পোস্টটি ভাল লাগলে বন্ধুদের সাথে সেয়ার করুন কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ফ্লোনেস্ট বিডির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url